মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, স্মার্ট ডিভাইস ও প্রযুক্তির ভালো দিকগুলো সবারই কমবেশি জানা। প্রযুক্তি মানুষের জীবনে যেমন সুফল বয়ে এনেছে, তেমনি এর অতিরিক্ত ব্যবহারে রয়েছে নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দুনিয়া হাতের মুঠোয় চলে এসেছে।
জানা যায়, অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী।
ধামরাই পৌরশহরের প্রায় দশটি পরিবারের স্কুল, কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, তাদের সন্তানরা বর্তমানে মোবাইল ফোন নিয়ে বেশি সময় কাটায়। মোবাইলে অনলাইন ক্লাস এর কথা বলে তারা বিভিন্ন ধরনের গেমস, মিডিয়া সাইড গুলোর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আমরা কিছু বলি না, কারণ তারা মোবাইলে ক্লাস করছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়েছে। এতে এক সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম মেধাশূন্য হওয়ার আশঙ্কা করছে।
বর্তমানে একজন শিশুকে খাবার খাওয়ানোর সময়ও মোবাইলে গেমস চালু করে দিতে হয়। সে কি খেল তা নিজেও জানে না। এখান থেকেই সে মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এটা এক ধরনের নেশা। আর করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মোবাইলই একমাত্র ভরসা শিক্ষার্থীদের।
উপজেলার চন্দ্রাইল এলাকার লালন মিয়া বলেন, মোবাইলের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। এখন ছোট ছেলে মেয়েরা খেলাধুলা না করে নিজ কক্ষে বা বাসার ছাদে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইল নিয়ে বসে আছে। খেলাধুলার প্রতি তাদের কোনো আগ্রহ নেই।
অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে নানা ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। কানে কম শুনা, চোখের দৃষ্টি শক্তির সমস্যা, রাতে ঘুম নষ্ট, স্নায়ু সমস্যা, মাথা ব্যথাসহ নানাবিধ শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। শুধু ছোট ছেলে মেয়েদেরই নয় বয়স্কদের এই সব সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে মোবাইলের নীল আলু বেশি ক্ষতিকর। মাঝে মধ্যে কানে ফোন নিয়ে গাড়ি চালানো বা রাস্তা পারাপারেও ঘটে নানা দুর্ঘটনা।
স্মার্টফোন বয়স্কদের চেয়ে ছোট শিশুদের জন্য হুমকি স্বরূপ। তারা পড়াশোনা না করে এক ধরনের মানসিক রোগীতে পরিণত হচ্ছে। কথা বললেই অল্পতে রোগে যায়।
পৌরবাসিন্দা কবির হোসেন বলেন, অনেক পারিবারিক কলহের সৃষ্টি হয় ছেলে মেয়েদের মোবাইল না দিলে। তিন দিন আগে কুমড়াইল এলাকার এক মহিলা তার সন্তানকে নিতে এসেছে। সে যাবে না। কারণ তার ছেলে মায়ের কাছে মোবাইল বায়না করেছেন। দিতে অস্বীকার করায় সে পড়া বাধ দিয়ে ম্যাক্সির হেলপাড় এর কাজ করছে। সেই টাকা দিয়ে মোবাইল ক্রয় করবে। এভাবে না জানা অনেকেই নিমজ্জিত হচ্ছে অন্ধকারে।
ব্যক্তিগত থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিকসহ অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ ডেকে আনতে পারে স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার। মোবাইল ফোন ব্যবহারে সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে, কিশোর অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে । সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিপার্শ্বিক নানা কারণে অপরাধীর তালিকায় নাম এসেছে অল্পবয়সীদের।
আইন-শৃঙ্খলার পাশাপাশি পারিবারিক শিক্ষার অভাবেও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। অনেক অভিভাবক সন্তান আনন্দ পাবে ভেবে স্মার্টফোন দিয়ে থাকে ছোট্ট শিশুর হাতে। এতে সে সাময়িক আনন্দ পেলেও শিক্ষা ও চরিত্র নষ্ট হচ্ছে। তাই চরিত্র গঠনের প্রতি অভিভাবকদের মনোযোগ দেয়া দরকার।
দেখা যায়, ফেসবুকের মাধ্যমে গ্রুপ তৈরি করেও অপরাধ করছে কিশোররা। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের কুপ্রভাবে অনেকে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ। এই সব ছেলে মেয়েরা শুধু পাড়া প্রতিবেশীর জন্য নয়, নিজের পরিবারের জন্যও বিপজ্জনক। মাদকের টাকার জন্য সন্তান পিতামাতাকে হত্যা করছে।
সুশীল সমাজের লোকজন মনে করছেন, বর্তমানে সামাজিক কর্মকাণ্ড, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না, খেলার মাঠ কমে এসেছে, পিতা মাতার ব্যস্ততার কারণে সন্তানকে সময় দিতে পারছে না। সামাজিকভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন না থাকায় কিশোররা সাইবার জগতে ঢুকছে। দেখছে ফেসবুক, ইউটিউব। অনেকে আবার পর্নোগ্রাফির দিকে এগিয়ে চলছে। বিপথগামী হচ্ছে এই সব সন্তানরা, জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।
এ বিষয়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর সহকারি প্রভাষক ড. মো. আলতাফ হোসেন বলেন, পরিবার ও সামাজিকভাবে সঠিক পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ করলে, সন্তানের প্রতি অভিভাবকরা সময় দিলে কিশোর অপরাধ কমবে। তাদের সব সময় ভালো কাজে উৎসাহ দিতে হবে। খেলাধুলার সুযোগ করে দিতে হবে। খুন, অপরাধ বিষয়ক কোনো টিভি শো না দেখাই ভালো। শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখবে। রাগ করা যাবে না। সন্তানের সাথে বন্ধুর মতো থাকতে হবে। স্মার্টফোন না দিয়ে পজিটিভ কাজে এগিয়ে দিতে হবে। এতে শিশু কিশোর অপরাধ কমে যাবে বলে আশা করেন তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা সমাজ সেবা কর্মকর্তা এস এম হাসান বলেন, বর্তমানে করোনার কারণে ছোট শিশুরা তাদের বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। ফলে তারা মোবাইল ফোনে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। তাছাড়া খেলাধুলার জায়গা না থাকায়, পিতা মাতার অবহেলাও শিশু কিশোররা বিভিন্ন ধরনের নেশা ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে।
প্রসঙ্গত, বেশ কিছু দিন আগেও ধামরাই থানা রোডের পশ্চিম পাশে জ্যোতি বিদ্যানিকেতনের সামনে পাঁচ ছয়জন ১০/১২ বছরের কয়েকজন শিশুকে প্রায়ই ড্যান্ডি সেবন করতে দেখা যায়। তারা বিভিন্ন বাসা বাড়িতে সুযোগ পেলেই চুরি করে থাকে।