অনলাইন ডেস্কঃ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের পতনের পর থেকে আত্মগোপনে রয়েছেন বরিশালের ৫৩ জন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। সেই সাথে বাড়ি ঘরে হামলা, ভাংচুর ও মামলার শিকার হয়েছেন ১৩ জন চেয়ারম্যান।
আবার কোথাও কোথাও চেয়ারম্যানের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে বিক্ষোভের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। যদিও আত্মগোপনে থাকা অনেক ইউপি চেয়ারম্যানরা গোপনে অফিসে গিয়ে স্বাক্ষর করে আসছেন, কেউ বা সচিবের মাধ্যমে বিভিন্ন ফাইল নিয়ে তাতে স্বাক্ষর করছেন।
আবার কেউ কেউ গোপনে অফিসে এসে ছবি তুলে গোপনেই চলে যাচ্ছে। ইউপি চেয়ারম্যানের দাবী হামলা মামলার ভয়ে তারা প্রকাশ্যে আসছেন না। সেক্ষেত্রে জেলার ৮৮ জন ইউপি চেয়ারম্যানের মধ্যে মাত্র ২৯ জন স্বশরীরে পরিষদে এসে দাপ্তরিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার ১০ উপজেলার ৮৮টি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্য ও নারী ইউপি সদস্য মিলে সহস্রাধিক জনপ্রতিনিধি রয়েছেন। যাদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পরে জেলার বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা গা ঢাকা দিয়েছেন।
কেউ কেউ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন সুবিধামত স্থানে। নিজ কার্যালয়ে আসছেন না অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি। এতে জন্মসনদ, মৃত্যুনিবন্ধন, নাগরিক সনদ, ট্রেড লাইসেন্সসহ কোনা প্রকার সেবা পাচ্ছে না নাগরিকরা।
আলী আশরাফ নামে কলসকাঠি ইউনিয়ন পরিষদে সেবা নিতে আসা এক ব্যক্তি বলেন, গত কয়েকদিন ধরে জন্মনিবন্ধনের কাজে পরিষদে আসলেও চেয়ারম্যান-মেম্বার কাউকে পাইনি।
জরুরি প্রয়োজন থাকলেও চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরের জন্য ভোগান্তিতে পড়েছি। বিষয়গুলো বিবেচনা করে সাধারণ নাগরিকদের দুর্ভোগ লাঘবে সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে দ্রুত একটি নির্দেশনা দেওয়া প্রয়োজন।
আবুল কালাম নামে আরেক সেবাপ্রার্থী বলেন, জানিনা কতদিন আমাদের এভাবে ভোগান্তি পোহাতে হবে। সাধারণ মানুষের কথা মাথায় রেখে দ্রুত কার্যক্রম স্বাভাবিক করার দাবি করছি। এদিকে অধিকাংশ ইউনিয়ন পরিষদে সচিব ও উদ্যোক্তাদের দেখা গেছে।
জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে জেলার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার আলিমাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান ইমরান হোসেন বাপ্পি অফিসে আসেন না, রয়েছেন আত্মগোপনে।
একই অবস্থা আন্দারমানিক ইউপি চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খোকন, বিদ্যানন্দপুর ইউপি চেয়ারম্যান শাহে আলম মীর, চাঁনপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ বাহাউদ্দিন ঢালী, গোবিন্দপুর ইউপি চেয়ারম্যান বেল্লাল মোল্লা, চরএককরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আঃ মকিম তালুকদার, চরগোপালপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ সামছুল বারী (মনির), জাংগালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল কাদের ফরাজী, মেহেন্দিগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান নিজাম উদ্দিন আহমেদ, শ্রীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মেঃ হারুন-অর-রশীদ ও জয়নগর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মনির হাওলাদারের।
এছাড়া উপজেলার লতা ইউপি চেয়ারম্যান আবু রাশেদ মনি’র বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। পরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মামলা নিয়ে পালাতক অবস্থায় রয়েছেন উলানিয়া (দক্ষিণ) ইউপি চেয়ারম্যান মিলন চৌধুরী ও উলানিয়া (উত্তর) ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ নূরুল ইসলাম জামাল মোল্লা।
এছাড়া এই উপজেলার ভাসানচর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ নজরুল ইসলাম চুন্ন অসুস্থ থাকায় তিনি পরিষদে আসতে পারছেন না। উপজেলার দড়িচরখাজুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মোস্তফা রাড়ি গত এক সপ্তাহ আগে স্টক করে ইন্তেকাল করেছেন।
উজিরপুর উপজেলার বামরাইল ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ইফসুফ হাওলাদারের বাড়িতে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনা ঘটেছে। তিনি এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছেন বলে জানা গেছে।
সাতলা ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহীন হাওলাদার সম্প্রতি মাছের ঘের নিয়ে দ্বন্দের জেরে ঘটে যাওয়া ডাবল হত্যা মামলার আসামী হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
এ ছাড়া আত্মগোপনে রয়েছেন বরাকোটা ইউপি চেয়ারম্যান এডভোকেট মো: সহিদুল ইসলাম মৃধা, গুঠিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো: আওরাঙ্গজেব, হারতা ইউপি চেয়ারম্যান অমল মল্লিক, জল্লা ইউপি চেয়ারম্যান বেবী রাণী দাস, ওটরা ইউপি চেয়ারম্যান এম.এ. খালেক ও শোলক ইউপি চেয়ারম্যান সরদার আব্দুল হালিম। তবে উপজেলার শিকারপুর ইউপি চেয়ারম্যান নজরুল মাঝি অসুস্থ থাকায় তিনিও পরিষদে যেতে পারছেন না।
বাবুগঞ্জ উপজেলার কেদারপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ নুরে আলমের উপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
এ ছাড়া উপজেলার মাধবপাশা ইউপি চেয়ারম্যান ছিদ্দিকুর রহমান বরিশাল জেলা বিএনপির অফিস ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ মামলায় পালাতক অবস্থায় রয়েছেন।
স্বশরীরে পরিষদে আসছেন না জাহাঙ্গীরনগর (আগরপুর) ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ কামরুল আহসান খান, চাঁদপাশা ইউপি চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, দেহেরগতি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মশিউর রহমান।
তবে নিয়মিত অফিস করছেন বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও রহমতপুর ইউপি চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আক্তার-উজ-জামান মিলন। তার দাবী, সব সহ্য করে তিনি পরিষদ পরিচালনা করছেন।
বানারীপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আঃ জলিল ঘরামী হামলা ভাংচুরের শিকার হয়েছেন। মামলা খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন চাখার ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ মুজিবুল ইসলাম টুকু।
এছাড়া আত্মগোপণে রয়েছেন বিশারকান্দি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ সাইফুল ইসলাম শান্ত, ইলুহার ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ শহিদুল ইসলাম। তবে উদয়কাঠি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ রাহাদ আহম্মেদ ননি আমেরিকার সিটিজেন হওয়ায় প্রায় সব সময়ই তিনি দেশের বাহিরে থাকেন।
এই উপজেলায় পরিষদ চালাচ্ছেন বাইশারী ইউপি চেয়ারম্যান শ্যামল চক্রবর্ত্তী, সলিয়াবাকপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো: সিদ্দিকুর রহমান ও সৈয়দকাঠী ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আনোয়ার হোসেন মৃধা।
গৌরনদী উপজেলার বার্থী আব্দুর রাজ্জাক হাওলাদার, বাটাজোর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আঃ রব হাওলাদার ও নলচিড়া ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম হাফিজ মৃধা আত্মগোপনে রয়েছেন। নানা কৌশলে অফিস করছেন মাহিলাড়া ইউপি চেয়ারম্যান সৈকত গুহ পিকলু অফিস, চাঁদশী ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, খাজাপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ নুর আলম সেরনিয়াবাত ও শরিকল ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ফারুক হোসেন মোল্লা। হিজলা উপজেলার ইউপি চেয়ারম্যানরা পরিষদে আসলেও পুরোপুরি প্রকাশ্যে আসছেন না। তারা হচ্ছেন ধুলখোলা ইউপি চেয়ারম্যান জামাল ঢালী, হরিনাথপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ তৌফিকর রহমান, বড়জালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ এনায়েত হোসেন হাওলাদার, গুয়াবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ শাহজাহান তালুকদার, হিজলা গৌরবদী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ নজরুল ইসলাম মিলন ও মেমানিয়া মোঃ নাসির উদ্দিন।
মুলাদী উপজেলার গাছুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মো: জসিম উদ্দিন হামলার শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া উপজেলার অন্যান্য ইউপি চেয়ারম্যানরা নানা কৌশল করে পরিষদে আসছেন। এরা হচ্ছেন বাটামারা ইউপি চেয়ারম্যান মো: সালাহ উদ্দিন, চরকালেখা ইউপি চেয়ারম্যান মিরাজুল ইসলাম, কাজিরচর ইউপি চেয়ারম্যান মো: মন্টু বিশ্বাস, মুলাদী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ কামরুল আহসান, নাজিরপুর ইউপি চেয়ারম্যান মো: মোস্তাফিজুর রহমান ও সফিপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আবু মুসা।
আগৈলঝাড়া উপজেলার বাকাল ইউপি চেয়ারম্যান বিপুল দাস ও রাজিহার ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ইলিয়াস তালুকদার আত্মগোপনে রয়েছেন। তবে অফিস করছেন বাগধা ইউপি চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বাবুল ভাট্টি, গৈলা ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ শফিকুল হোসেন ও রত্নপুর ইউপি চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা সরদার। জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার ভরপাশা ইউপি চেয়ারম্যান আশ্রাফুজ্জামান খান থোকন অফিসে আসেন না। একই ভাবে অফিসে আসছেন না চরামদ্দি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ সাহাব উদ্দিন খোকন, কলসকাঠি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ ফয়সাল ওয়াহিদ মুন্না। চরাদী ইউপি চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম ৫ আগষ্টের অনেক আগেই দেশ ছেড়ে আমেরিকা চলে গেছেন। এছাড়া অন্যান্য ইউপির চেয়ারম্যানরা বিশেষ কাজ ছাড়া অফিসে আসছেন না। যেমন দাড়িয়াল ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ সহিদুল ইসলাম হাওলাদার, দুর্গাপাশা ইউপি চেয়ারম্যান মো: হানিফ তালুকদার, ফরিদপুর ইউপি চেয়ারম্যান এস.এম শফিকুর রহমান, গারুরিয়া ইউপি চেয়ারম্যান এস.এম কাইয়ুম খান, কবাই ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ জহিরুল হক তালুকদার, নলুয়া ইউপি চেয়ারম্যান আ.স.ম ফিরোজ আলম খান, পাদ্রিশিবপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ জাহিদুল হাসান, রঙ্গশী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ বশির উদ্দিন। এছাড়া নিয়মিত অফিস চালিয়ে যাচ্ছেন নিয়ামতি ইউপি চেয়ারম্যান মো: হুমায়ুন কবির ও দুধল ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ গোলাম মোর্শেদ খান।
বরিশাল সদর উপজেলার কাশীপুর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ কামাল হোসেন মোল্লার বাড়িতে হামলা ও মামলার ঘটনা ঘটেছে। একই অবস্থা রায়পাশা-কড়াপুর ইউপি চেয়ারম্যান আহম্মদ শাহরিয়ার বাবু এলাকায়।
সেখানে ইতোমধ্যে প্যানেল চেয়ারম্যানও গঠন করা হয়েছে। এছাড়া আত্মগোপণে রয়েছেন চাঁদপুরা ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ জাহিদ হোসেন, চরবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ মাহতাব হোসেন সুরুজ, শায়েস্তাবাদ ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আরিফুজ্জামান মুন্না ও টুংগীবাড়ীয়া ইউপি চেয়ারম্যান নাদিয়া রহমান।
অফিস করছেন চন্দ্রমোহন ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ সিরাজুল হক, চরমোনাই ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ মো: জিয়াউল করিম ও জাগুয়া ইউপি চেয়ারম্যান হেদায়াতুল্লাহ খান। যে সব জায়গায় চেয়ারম্যানরা অনুপস্থিত রয়েছেন সেখানে কাজ চালিয়ে নিতে প্যানেল চেয়ারম্যানদের দায়িত্ব পালন করতে পরিপত্র জারি করেছে সরকার। এমন অবস্থায় কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছে বরিশালের বিভিন্ন ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও জনপ্রতিনিধিরা। নাম প্রকাশ না করা শর্তে বাবুগঞ্জের এক ইউপি চেয়ারম্যান বলেন, “আমি এলাকায় আছি, পরিষদেও যাই। যদি সরকার চায় পদে থাকবো, না চাইলে সরে যাবো”।
বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহাবুব উল্লাহ মজুমদার বলেন, গত ৫ তারিখ থেকে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান অনুপস্থিত রয়েছেন। তাদের পরিষদ আসার জন্য বলা হয়েছে। অনেকেই সমন্বয় কমিটির মিটিং আসেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগ বরিশালের উপ-পরিচালক গৌতম বাড়ৈ বলেন, কর্মস্থলে উপস্থিত ইউপি চেয়ারম্যানদের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে জানতে চেয়েছিল। পরে আমরা এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠিয়েছি। যে সব ইউপিতে চেয়ারম্যানরা কোন ভাবেই আসতে পারছে না সেখানে নিবন্ধক নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে।