দোয়া মুমিনের হাতিয়ার। অসম্ভবকে সম্ভব করার মাধ্যম। মহান রবের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের সেতুবন্ধন।
মানবজীবনে দোয়ার গুরুত্ব অনেক। তাই দোয়া না করলে বা উদাসিন থাকলে আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন। এক হাদীসে নবীজি বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে দোয়া করে না আল্লাহ তার ওপর রাগ হন। (সুনানে তিরমিজি: ৩৩৭৩)।
দোয়া কবুল হওয়ার বেশকিছু শর্ত রয়েছে
যেমন: ১. আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে না ডাকা
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে আব্বাসকে (রা.) উদ্দেশ্য করে বলেন: যখন প্রার্থনা করবে তখন শুধু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করবে এবং যখন সাহায্য চাইবে তখন শুধু আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাইবে। (সুনানে তিরমিযি (২৫১৬), আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন)
এটাই হচ্ছে আল্লাহর বাণীর মর্মার্থ ‘আর নিশ্চয় মসজিদসমূহ আল্লাহ্রই জন্য। কাজেই তোমরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে ডেকো না। (সূরা জিন, আয়াত: ১৮)
দোয়ার শর্তগুলোর মধ্যে এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এ শর্ত পূরণ না হলে কোনো দোয়া কবুল হবে না, কোন আমল গৃহীত হবে না। অনেক মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের মাঝে ও আল্লাহর মাঝে মৃতব্যক্তিদেরকে মাধ্যম বানিয়ে তাদেরকে ডাকে। তাদের ধারণা যেহেতু তারা পাপী ও গুনাহগার, আল্লাহর কাছে তাদের কোন মর্যাদা নেই; তাই এসব নেককার লোকেরা তাদেরকে আল্লাহ্র নৈকট্য হাছিল করিয়ে দিবে এবং তাদের মাঝে ও আল্লাহ্র মাঝে মধ্যস্থতা করবে।
এ বিশ্বাসের কারণে তারা এসব বুজুর্গদের মধ্যস্থতা ধরে এবং আল্লাহ্র পরিবর্তে এ মৃতব্যক্তিদেরকে ডাকে। অথচ আল্লাহ্ বলেছেন: আর আমার বান্দারা যখন আপনাকে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে (তখন আপনি বলে দিন) নিশ্চয় আমি নিকটবর্তী। দোয়াকারী যখন আমাকে ডাকে তখন আমি ডাকে সাড়া দিই। (সূরা বাকারা, আয়াত: ১৮৬)
২. শরিয়ত অনুমোদিত কোন একটি মাধ্যম দিয়ে আল্লাহতায়ালার কাছে ওসিলা দেওয়া
৩. দোয়ার ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করা। তাড়াহুড়া করা দোয়া কবুলের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
হাদিসে এসেছে, তোমাদের কারো দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না সে তাড়াহুড়া করে বলে যে: ‘আমি দোয়া করেছি; কিন্তু, আমার দোয়া কবুল হয়নি। (সহিহ বুখারী (৬৩৪০) ও সহিহ মুসলিম (২৭৩৫)
সহিহ মুসলিমে (২৭৩৬) আরও এসেছে- বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে। বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা ফলাফল প্রাপ্তিতে তাড়াহুড়া না করে। জিজ্ঞেস করা হল: ইয়া রাসূলুল্লাহ! তাড়াহুড়া বলতে কী বুঝাচ্ছেন? তিনি বললেন: বলে যে, আমি দোয়া করেছি, আমি দোয়া করেছি; কিন্তু আমার দোয়া কবুল হতে দেখিনি। তখন সে ব্যক্তি উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং দোয়া ছেড়ে দেয়।
৪. দোয়ার মধ্যে পাপের কিছু না থাকা। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া না হওয়া; যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখিত হাদিসে এসেছে- বান্দার দোয়া ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করা হয় যতক্ষণ পর্যন্ত না বান্দা কোন পাপ নিয়ে কিংবা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা নিয়ে দোয়া করে।
৫. আল্লাহ্র প্রতি ভালো ধারণা নিয়ে দোয়া করা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমন। (সহিহ বুখারী (৭৪০৫) ও সহিহ মুসলিম (৪৬৭৫)
আবু হুরায়রার (রা.) হাদিসে এসেছে, তোমরা দোয়া কবুল হওয়ার দৃঢ় বিশ্বাস (একীন) নিয়ে আল্লাহ্র কাছে দোয়া কর। (সুনানে তিরমিযি, আলাবানী সহিহুল জামে গ্রন্থে (২৪৫) হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন)
তাই যে ব্যক্তি আল্লাহ্র প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করে আল্লাহ্ তার উপর প্রভুত কল্যাণ ঢেলে দেন, তাকে উত্তম অনুগ্রহে ভূষিত করেন, উত্তম অনুকম্পা ও দান তার উপর ছড়িয়ে দেন।
৬. দোয়াতে মনোযোগ থাকা। দোয়াকালে দোয়াকারীর মনোযোগ থাকবে এবং যার কাছে প্রার্থনা করা হচ্ছে তার মহত্ত্ব ও বড়ত্ব অন্তরে জাগ্রত রাখবে।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তোমরা জেনে রাখ, আল্লাহ্ কোন উদাসীন অন্তরের দোয়া কবুল করেন না। (সুনানে তিরমিযি (৩৪৭৯), সহিহুল জামে (২৪৫) গ্রন্থে শাইখ আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন)
৭. খাদ্য পবিত্র (হালাল) হওয়া। আল্লাহ্ তাআলা বলেন, আল্লাহ্ তো কেবল মুত্তাকীদের থেকেই কবুল করেন। (সূরা মায়েদা, আয়াত: ২৭)
এ কারণে যে ব্যক্তির পানাহার ও পরিধেয় হারাম সে ব্যক্তির দোয়া কবুল হওয়াকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সুদূরপরাহত বিবেচনা করেছেন।
হাদিসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এমন ব্যক্তির কথা উল্লেখ করেন, যিনি দীর্ঘ সফর করেছেন, মাথার চুল উস্কুখুস্ক হয়ে আছে; তিনি আসমানের দিকে হাত তুলে বলেন: ইয়া রব্ব, ইয়া রব্ব! কিন্তু, তার খাবার-খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পরিধেয় হারাম, সে হারাম খেয়ে পরিপুষ্ট হয়েছে তাহলে এমন ব্যক্তির দোয়া কিভাবে কবুল হবে? সহিহ মুসলিম, (১০১৫)
ইবনুল কাইয়্যেম (রহ.) বলেন, হারাম ভক্ষণ করা দোয়ার শক্তিকে নষ্ট করে দেয় ও দুর্বল করে দেয়।
৮. দোয়ার ক্ষেত্রে কোন সীমালঙ্ঘন না করা। কেননা আল্লাহতায়ালা দোয়ার মধ্যে সীমালঙ্ঘন করাটা অপছন্দ করেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের রবকে ডাক; নিশ্চয় তিনি সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না। (সূরা আরাফ, আয়াত: ৫৫)
৯. ফরজ আমল বাদ দিয়ে দোয়াতে মশগুল না হওয়া। যেমন, ফরজ নামাজের ওয়াক্তে ফরজ নামাজ বাদ দিয়ে দোয়া করা কিংবা দোয়া করতে গিয়ে মাতাপিতার অধিকার ক্ষুণ্ণ করা।
খুব সম্ভব বিশিষ্ট ইবাদতগুজার জুরাইজের (রহ.) কাহিনী থেকে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কারণ জুরাইজ (রহ.) তার মায়ের ডাকে সাড়া না দিয়ে ইবাদতে মশগুল থেকেছেন। ফলে মা তাকে বদদোয়া করেন; এতে করে জুরাইজ (রহ.) আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন।
ইমাম নববী (রহ.) বলেন, আলেমরা বলেছেন: এতে প্রমাণ রয়েছে যে, জুরাইজের জন্য সঠিক ছিল মায়ের ডাকে সাড়া দেয়া। কেননা তিনি নফল নামাজ আদায় করছিলেন। নফল নামাজ চালিয়ে যাওয়াটা হচ্ছে- নফল কাজ; ফরজ নয়। আর মায়ের ডাকে সাড়া দেওয়া ওয়াজিব এবং মায়ের অবাধ্য হওয়া হারাম….(শারহু সহিহু মুসলিম (১৬/৮২)