জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মূখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কী হবে সেটি তাদের কাজের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। সম্পর্ক ভালো রাখতে চাইলে ভারতকে খুনি শেখ হাসিনাকে আশ্রয় না দিয়ে ফেরত দিতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ তার বিচার করবে।
শনিবার দুপুরে রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে জুলাই শহিদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘শহিদ পরিবারের পাশে বাংলাদেশ’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেও ছেড়ে কথা বলবেন না বলেও মন্তব্য করেছেন সারজিস আলম।
তিনি বলেন, আমরা শুধু বাংলাদেশ পুলিশ নয়। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সবাইকে একটি জিনিস আমাদের জায়গা থেকে অনুরোধ করতে চাই। আমরা কারও অন্ধ দালাল নই। আমরা ক্ষমতাপিপাসু নই। বিবেকবোধের জায়গায় যদি আমাদের মনে হয়, যে কেউ এই অভ্যুত্থানের স্পিরিটের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন, ইভেন প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসও যদি হয়, আমরা তাকেও ছেড়ে কথা বলব না।
সারজিস আলম বলেন, আমরা বিবেকবোধ বেচে দেওয়া ওই প্রজন্ম নয়। তাহলে আমরা আমাদের প্রতিবেশী বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ভারতের দালালি করতাম। কিন্তু আমরা তা করিনি, করবো না।
সারজিস আরও বলেন, যারা গণহত্যায় সরাসরি জড়িত ছিল তাদের আমরা বিন্দুমাত্র ছাড় দেব না। পুলিশ হোক, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ পরিচয় যা-ই হোক, এই পরিচয়গুলো মূখ্য নয়। তার বিরুদ্ধে যদি ডকুমেন্ট থাকে তাহলে আমাদের কাছে তার একমাত্র পরিচয় একজন খুনি, হত্যাকারী। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
এখনও আওয়ামী লীগের অনেক নেতা গ্রেফতার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সারজিস বলেন, চব্বিশের অভ্যুত্থানের চার মাস পেরিয়েছে। খুনি হাসিনার অন্যতম দোসর নাটোরের খুনি এমপি শিমুল আজও আমাদের সামনে রয়েছে। আজও পাবনার সাঈদ চেয়ারম্যান, এই বাংলাদেশে তার অস্তিত্ব রয়েছে। অথচ এই খুনিরা প্রকাশ্যে আমার ভাইদেরকে পুড়িয়ে মেরেছে, গুলি করে হত্যা করেছে। তাহলে বাংলাদেশের ওই বিচারব্যবস্থা, পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যারা আছেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-বিচার ব্যবস্থার উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন যে শহিদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আজকে আপনারা উপদেষ্টা, পুলিশ সুপার, আইজিপি, ডিআইজি, বিভাগীয় কমিশনার- তাদের রক্তের সঙ্গে এই বেঈমানি কিভাবে সম্ভব?
শহিদদের লাশ তুলে ময়নাতদন্ত না করার আহ্বান জানিয়ে সারজিস আলম বলেন, চব্বিশের অভ্যুত্থানে যারা শহিদ হয়েছে তাদের হত্যা মামলার জন্য কারও লাশ উত্তোলন করা যাবে না। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিচারিক যে মন্ত্রণালয় রয়েছে, সংশ্লিষ্ট সকলকে একটি কথা বলে দিতে চাই- যে ভাইয়ের জীবনের রক্তের ওপরে ওই চেয়ারে আপনারা বসে রয়েছেন, আপনারা চারমাস পর তাদের লাশ উত্তোলন করতে পারেন না।
তিনি প্রশ্ন তোলেন, ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার পরিবারকে হত্যার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিচারের জন্য যদি ডেডবডি কবর থেকে তোলা না হয়, তাহলে এই চব্বিশের অভ্যুত্থানে নতুন বাংলাদেশ আনতে গিয়ে যারা শহিদ হয়েছে কেনো তাদের লাশ উত্তোলন করতে হবে?
গণহত্যায় জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই গণহত্যার সঙ্গে আমরা পুরো বাংলাদেশ পুলিশকে জড়িয়ে দেব না। কিন্তু দায়সারা কথাও আমরা মেনে নেব না যে, খুনি হাসিনা বলেছিল বলে গুলি করেছি। খুনি হাসিনা যদি গুলি চালানোর হুকুমও দেয়, তাহলে একজন ব্যক্তি হিসেবে আপনার মনুষ্যত্ববোধ, দেশের মানুষের জন্য যে শপথ নিয়েছেন, সে মনুষ্যবোধ কোথায় ছিল? কতিপয় পুলিশ সদস্য সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, তাদের কেনো এখনও বিচার হচ্ছে না? আজকে আমরা দেখছি ওইসব পুলিশ নতুন করে পোস্টিংয়ের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। খুনের শাস্তি কি শুধু বদলি?
তিনি বলেন, পুলিশ সেই মামলাগুলো নিচ্ছে না, যে মামলাগুলোতে তাদের পুলিশ সদস্যদের নাম রয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক সমঝোতা হচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ওই খুনি আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগকে টাকার বিনিময়ে বাঁচানোর জন্য ব্যাকডোরে নেগোশিয়েশন করছে। এই যে মামলা বাণিজ্য, এতে রাজনৈতিক দল যেমন জড়িত রয়েছে তেমনি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও জড়িত রয়েছে। নতুন বাংলাদেশেও পুলিশ সদস্য বিভিন্ন জায়গায় মামলাবাণিজ্য করছে।
গণহত্যায় জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিচারে পুলিশকেই সহায়তার আহ্বান জানিয়ে এই ছাত্রনেতা বলেন, পুলিশের যে সকল সদস্য গণহত্যায় জড়িত ছিল, যারা জড়িত ছিলেন না তারা যদি তাদের বিচারের জন্য সহযোগিতা না করেন, তাহলে পরোক্ষভাবে আপনারাও গণহত্যায় জড়িত হয়ে যাবেন। কালো দাগ লেগে গেছে পুলিশে, এই কালিমা আপনাদেরই মুছতে হবে।
সারজিস বলেন, কোনো রাজনৈতিক দলের দালালি আপনাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করি না। আপনারা এটা করবেন না। পুলিশ দায়িত্বশীল হলে আগামী ৬ মাসেই বাংলাদেশ ঠিক হয়ে যাবে।
অনুষ্ঠানে রাজশাহী বিভাগের ৬৩টি শহিদ পরিবারের মধ্যে ৪৬ জন পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকার করে চেক দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ, রাজশাহী মহানগর পুলিশের কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ানসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কয়েকজন সমন্বয়ক বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে শহিদ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।